শুক্রবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১০

awami bakshal

Bakshal Ordinance 1975 (Jan25-Aug15) : A Dark Spot in the History of Bangladesh ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি। জাতীয় সংসদে মাত্র মিনিট পাঁচেকের আলোচনার অভিনয় করেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কবর দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। জাতীয় সংসদের বিশাল কক্ষে উপস্হিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের অসহায়, বিমুঢ় জনগণের কাঁধে নির্দ্বিধায় একদলীয়, চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্হার জোয়াল চাপিয়ে দিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এক লহমায় বনে গেলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগসহ দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে জন্ম দেয়া হলো দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল, যার নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল। বাক স্বাধীনতার টুঁটি টিপে হত্যা করে চারটি সংবাদপত্র ব্যতীত সকল সংবাদপত্র প্রকাশনার অনুমোদন বাতিল করা হলো। রাষ্ট্রপ্রধান, তার পরিবারবর্গ এবং অপরাপর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গের স্তাবকতার জন্য বাঁচিয়ে রাখা হলো ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস এবং বাংলাদেশ অবজারভার। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রণীত শাসন ব্যবস্হা যে কি পরিমাণ ফ্যাসিষ্ট প্রকৃতির ছিল, সেটি সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ দুটি থেকেই উপলব্ধি করা সম্ভবঃ
‘‘অনুঃ ১১৭ক। জাতীয় দল। ১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মুলনীতিসমুহের কোনো একটা পরিপুর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরুপ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি, আদেশ দ্বারা, নির্দেশ দিতে পারিবেন যে, রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে।
২) যখন (১) দফার অধীন কোনো আদেশ প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন।
৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কার্যসুচি, সদস্যভুক্তি, শৃঙ্খলা, অর্থসংস্হান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে।
৪)(৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কতৃক প্রণীত আদেশ-সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যোগ্য হইবেন।
অনুঃ ৩৪। রাষ্ট্রপতি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান। সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে,
ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পুর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শুন্য হইবে;
খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।”

বাংলাদেশের জনগণের সৌভাগ্য যে উপরোক্ত গণবিরোধী, নিবর্তনমুলক একদলীয় শাসন ব্যবস্হার স্হায়িত্বকাল ছিল সাকুল্যে ৬ মাস ২০ দিন। তবে সেই স্বল্প সময়ের নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো দেশবাসীর মনে জাগরুক রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। ১৯৭৭ সালে মরহুম জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্হায় রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তার ঐতিহ্যবাহী দলকে হত্যা করেছিলেন এবং সেই মৃত দলের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমান।

পাঠক হয়তো ভাবছেন ২০০৮ সালে এসে আমি ১৯৭৫ সালের কাহিনী উত্থাপন করছি কেন? জনগণ বুঝতে পারছেন কিনা জানি না, তবে নির্বাচনের নামে বাংলাদেশে আবারো একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্হা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই কারণেই ১৯৭৫ সাল এখনো আমাদের কাছে অতি প্রাসঙ্গিক। এদেশ থেকে একদলীয় শাসন ব্যবস্হা বিতাড়িত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর এক সামরিক ফরমানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে অবশ্য ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে সংসদে পঞ্চম সংশোধনী গ্রহণ করা হলে বাকশাল বিতাড়নকারী উল্লিখিত সামরিক ফরমানটি সাংবিধানিকভাবে বৈধতাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কতৃêক চরম অগণতান্ত্রিক ব্যবস্হা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো ভুমিকা ছিল না; বরং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবারো বাংলাদেশের জনগণকে একদলীয় শাসন ব্যবস্হার নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার যে দেশি-বিদেশি আয়োজন চলছে, সেখানে অনভিপ্রেতভাবে সেনাবাহিনীর একাংশের ভুমিকা রয়েছে বলেই অধিকাংশ নাগরিকের ধারণা।

এক-এগারোর পুর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা নিন্দিত সরকারের ক্রমতালিকায় প্রথম দুটি স্হান অধিকার করেছিল যথাক্রমে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি-পরবর্তী বাকশাল সরকার এবং জেনারেল (অব.) এরশাদের আট বছর মেয়াদি স্বৈরসরকার। গণবিরোধিতার বিচারে পুর্বোক্ত দুটি সরকারের সঙ্গে এখন সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ২২ মাস বয়সী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সরকারের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কর্তাব্যক্তিরা তাদের অজনপ্রিয়তার বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত আছেন। সরকারের সঙ্গিন অবস্হার বিষয়টি সম্পর্কে তাদের বিদেশি মুরব্বিরাও এতদিনে জেনে গেছেন বলেই আমার ধারণা। এমতাবস্হায় ক্ষমতাসীন নীতি-নির্ধারকবৃন্দ একটি একতরফা এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করায় আমি অন্তত বিস্মিত হইনি। নবরুপে বাকশাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের মতোই সুশীল (?) সমাজের নানাভাবে সমর্থন প্রদানও প্রত্যাশিত। বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তৎকালীন সুশীলরা (?) রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের পদস্পর্শ করে যেভাবে সংহতি প্রকাশ করতেন সেই স্মৃতি ভুলে যাই কি করে? সেই সকল সুশীলের (?) মধ্যে অনেকে এখনো জীবিত রয়েছেন। এদেরই একজন বর্তমানের ডাকসাইটে সুশীল (?) নেতা এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের একান্ত আপনজন ড. কামাল হোসেন বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছিলেন। একই ড. কামাল যে এক-এগারোর একজন প্রধান রুপকার, তাও তো দেশবাসীর অজানা থাকার কথা নয়।

১৯৭৫ সালের তুলনায় এখনকার কুশীলবরা একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে অবশ্য অধিকতর সুবিধাজনক অবস্হানে রয়েছেন। সেই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের সঙ্গে একেবারেই সম্পৃক্ত ছিল না। আর এবার স্বয়ং সেনাবাহিনী প্রধানের সহোদর এবং তার কন্যা-জামাতার ভাই (পুত্রা) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। একজন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরুপে এবং অন্যজন এক-এগারো প্রক্রিয়ার সরাসরি আঁতাতভুক্ত আওয়ামী লীগ থেকে। সেনাবাহিনী প্রধানের সহোদরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ একজন দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে, যাতে সেনাপ্রধানের ভাই সহজেই নির্বাচনে বিজয় লাভ করতে পারেন। বাংলাদেশের বিগত আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কখনো ক্ষমতাসীন সেনাপ্রধানের সহোদর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন ঘটনা স্মরণে আসছে না। এরপর বর্তমান প্রশাসনকে নিরপেক্ষ আখ্যায়িত করার আর কোনো সুযোগ নিশ্চয়ই থাকে না। ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন ব্যবস্হা প্রণয়নে সেনাবাহিনীর কোনো রকম ভুমিকা না থাকলেও পুর্বেই বলেছি এবারের চিত্র ভিন্নতর। তদুপরি এবারকার আন্তর্জাতিক পরিস্হিতি একদলীয় শাসন ব্যবস্হা প্রবক্তাদের অধিকতর অনুকুলে। সত্তর-এর দশকে বিশ্ব দুটি বিবদমান শিবিরে বিভক্ত থাকায় বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমুহের দরকষাকষির একটা সুযোগ অন্তত ছিল। আর এখন সারাবিশ্বে দাপট দেখাচ্ছে একমাত্র পরাশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্বেচ্ছাচারী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত বর্তমানে আণবিক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ। এই মিলিত শক্তি বাংলাদেশে একটি কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী একদলীয় শাসন ব্যবস্হাকেই যে তাদের স্বার্থের অনুকুল বিবেচনা করবে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। স্মরণে রাখা দরকার ইরাকে ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টির নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ব্যবহার করেই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দশকের পর দশক মধ্যপ্রাচ্যে অনৈক্য জিইয়ে রেখে প্রয়োজন ফুরানো মাত্র তাকে হত্যা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির কাছে এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র কিংবা নাগরিকের মৌলিক অধিকার কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রয়োজন হচ্ছে যে কোনো মুল্যে সর্বঅবস্হায় মাথা নাড়ানো একটি পুতুল সরকার। কাজেই দুঃসংবাদ হচ্ছে এবারের একদলীয় সরকার ১৯৭৫ সালের তুলনায় দীর্ঘস্হায়ী হওয়ার আশঙ্কাই অধিক। জরুরি আইনকে ব্যবহার করে একটি পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে এই অনৈতিক এবং দেশের স্বার্থবিরোধী প্রক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের মতো বৈধতা দান করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত চারদলীয় জোটের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তবে দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী জনগণকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দীর্ঘস্হায়ী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তা এখনই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন